Monday, February 13, 2017

বাংলাদেশে মিড লেভেল ম্যানেজার পাওয়া যায় না

বাংলাদেশে মিড লেভেল ম্যানেজার পাওয়া যায় না। আমাদের অসংখ্য ভালো এন্ট্রি লেভেল কর্মী আছে। ফ্রেশ এবং বুদ্ধিমান। আমাদের অনেক ভালো ভিশনারি লিডার আছেন। কিন্তু মাঝখানটা একদম ফাঁকা। মাঝখানের কর্মী নেই, একদম নেই।

এটাই বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচে বড় বাধা। মানুষ তো আছে প্রচুর, কিন্তু তাদেরকে ম্যানেজ করার মতো মানুষ নেই। ছোট একটা প্রজেক্ট তুলতেও মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমাদের এই শিক্ষাটা নেই।

একজন ভারতের কিংবা শ্রীলংকার ম্যানেজার যেরকম দক্ষ হয়, সময়ের ব্যাপারে যেমন পটু হয়, ডেডলাইন মিস করে না, কিংবা একটা টিমকে যেভাবে ফোকাস রাখতে পারে, আমাদের ছেলেমেয়েরা সেটা পারে না। তারা এটাকে নিজের বাসা-বাড়ি বানিয়ে ফেলে। নয়তো চরম কঠিন বস হয়ে সবার ওপর ছড়ি ঘুরাতে থাকে। এটাকে প্রফেশনালি কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, সেটা আমরা শিখিনি এবং শিখছি না।

বাংলাদেশ থেকে একটি বড় অঙ্কের টাকা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যায়, তার একটি বড় পরিমাণ হলো তাদের কর্মীরা আমাদের এখানে কাজ করে। এবং এটাকে কিন্তু ফেলে দেওয়া যাবে না। কালকে যদি আপনি এদেরকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেদের লোক দিয়ে চালাতে চান, তাহলে শিল্পগুলো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের গ্রোথের সঙ্গে এরা জড়িত। তবে নিশ্চিয়ই এটা কারো কাম্য নয়।  চলুন কয়েকটা সেক্টরের দিকে তাকাই, তাহলে অনেকের ধারণা পরিষ্কার হতে পারে।

প্রথমেই বলি মিডিয়ার কথা। বাংলাদেশের মিডিয়াতে কাজ করেন অসংখ্য সিনিয়র সাংবাদিক এবং এডিটর পাওয়া যাবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ভালো সিইও পাওয়া যাবে। তবে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার মতো মাঝ পর্যায়ের মানুষ নেই; ম‌্যানেজার নেই। আপনি প্রতিটি হাউজ ধরে ধরে দেখুন। মাথা আছে অনেক; কিন্তু ভালো ম্যানেজার নেই, যারা একেকটি আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারে, আইডিয়াটাকে সময়মতো তুলে আনতে পারে এবং অনুষ্ঠানটিকে যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেভাবেই ব্রডকাস্ট করতে পারে। আর এটা নেই বলেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে প্রতিটি দিন চিৎকার করতে করতে গলা ব্যাথা করতে হয়। আর যদি সেটা কেউ না করেন, তাহলে সেখানে ভালো অনুষ্ঠান আর হয়ে ওঠে না। আমাদের টিভিগুলোর থেকে যে কলকাতার টিভি আলাদা তার একটি মূল কারণই হলো, মাঝ স্তরের ম্যানেজার কিংবা কর্মীর সংখ্যা এবং তাদের গুণগত মান।

এবারে টেলিকমগুলোর কথা বলি। বাংলাদেশের টেলিকমগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছে। কারণ এখানে তাদের অল্প খরচে নেটওয়ার্ক করা হয়ে গিয়েছে। এত অল্প জায়গা এত বেশি গ্রাহক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আর সেবা খারাপ দিলেও কারও কিছু আসে যায় না। ফলে তারা ব্যবসা হিসেবে ভালো করেছে। কিন্তু মাঝারি সারিতে ম্যানেজার কি খুব ভালো পেয়েছে? কিংবা দেশে তৈরি হয়েছে? একদম যে তৈরি হয়নি তা নয়। টেলিকমগুলো তাদের কিছু মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু তার সংখ্যা খুব কম। বাংলাদেশে টেলিকম শিল্প প্রায় ২০ বছরের। কতজন ভালো ম্যানেজার আমরা পেয়েছি? বাংলাদেশের টেলিকমগুলোর একটা বড় ব্যবস্থাপনা দেখে বিদেশি ম্যানেজাররা। দেশিরা তাদের পাশে থাকে। তবে কেউ কেউ বেশ ভালো করছেন। কিন্তু সেটা পুরো শিল্পের তুলনায় খুব কম।

বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্পে মাঝারি খাতে কোনোও ম্যানেজার নেই। একদম শূন্য। আমাদের ভালো প্রোগ্রামার আছে। তাদের ব্রেইন আছে। কিন্তু একটা প্রজেক্ট কীভাবে পরিকল্পনা করতে হয়, কীভাবে দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হয়, কীভাবে সময়টাকে ভালো করে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে দায়িত্ব নিয়ে প্রজেক্ট তুলে ফেলতে হয়, এই জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। তারা ব্রিলিয়ান্ট, এই ব্যাপারে কোনোও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের ব্যবস্থাপনার দক্ষতা একদমই নেই। আমি বাংলাদেশের অসংখ্য সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানকে চিনি, যারা ভালো ম্যানেজারের কারণে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটিকে পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারছেন না। যিনি শুরু করেছিলেন, তিনি একাই পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, যত দিন পারেন। পরবর্তীতে হাল ধরার আর কেউ তৈরি হচ্ছে না। যেকারণে বাংলাদেশে সফটওয়্যার শিল্প সামনে এগোতে পারবে না। মুখে আপনি যত বিলিয়ন ডলারের কথাই বলুন না কেন, ফলাফল তেমন একটা হবে না। তাই বিগত ২৫ বছর ধরে সেই একই প্যাঁচাল আমরা শুনে যাচ্ছি। সমস্যাটা হলো, ভালো দক্ষ ম্যানেজার।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কিছু ম্যানেজার আছে, তবে তাদের সংখ্যাও খুব কম। সেখানে অসংখ্য বিদেশি ম্যানেজার কাজ করেন, যাদের দক্ষতার কারণে আমাদের পোশাক শিল্পটি সামনে এগিয়ে চলেছে। এর বাইরে আমাদের এমন কোনোও খাত নেই যেখানে সঠিক ম্যানেজার আছে। একটি ব্যাংকে যান, এমনকি প্রাইভেট ব্যাংক, রেস্টুরেন্টে যান, পর্যটন কেন্দ্রে যান, জাহাজে উঠেন, উড়োজাহাজে চড়েন, বিমানবন্দর ব্যবহার করেন, বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখেন, সব ফাঁকা। মানুষের অভাব নেই। কিন্তু সুন্দর গুছিয়ে দায়িত্ব নিয়ে একটি বিভাগ চালাবে, সেটা নেই। যে কারণে যেখানেই যাবেন, একটা অব্যবস্থাপনা। সব দায়িত্ব যেন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের। মাঝখানে যারা আছেন, তারা দায়িত্ব নিতে পারেন না; গুছিয়ে কাজটা করতে পারেন না।

এবারে দেশ পরিচালনার কথা বলবেন? দেখেন ভালো করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে কীভাবে কাজগুলো করছেন। তার পরের ধাপগুলো? সবাই যেন তাকিয়ে আছে সেই একজনের দিকে। আর যাকেই তিনি দায়িত্ব দিচ্ছেন, তিনি রাতারাতি চুরি-ডাকাতি করে, পুরো অব্যবস্থাপনায় ভরে, নিজের আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দিয়ে সেই বিভাগটার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ আরও অনেক ভালো করতে পারত, যদি এই দেশ সঠিক ম্যানেজার পেয়ে যেত।

বাংলাদেশ যে কারণে ভালো ম্যানেজার পায় না কিংবা তৈরি হয় না, তার একটি মূল কারণ হলো শর্টকাট। ক্যারিয়ারে আমরা খুব দ্রুত উপরে উঠে যেতে চাই। সম্ভব হলে প্রধান নির্বাহী (সিইও)। আর যদি ওই প্রতিষ্ঠানের সিইও হতে না পারি, তাহলে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান খুলে সেটার সিইও হয়ে গেলাম। সিইও আমাকে হতেই হবে, গোলাম হোসেন!

বাংলাদেশে যে একটু কাজ শিখে ফেলে কিংবা ভালো ট্রেনিং পায়, সে তখন ভাবতে শুরু করে- ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য সেই যোগ্য সিইও। তার সামনে যে আরও ২০ বছরের ক্যারিয়ার আছে, সেটা তার মাথায় থাকে না। কেউ ৩০ বছরের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশে ক্যারিয়ার তৈরি করে না। সবাই মোটামুটি স্বল্পকালীন চিন্তাভাবনা থেকে চাকরি করে। তাই তার দক্ষতা তৈরির খুব একটা প্রয়োজন পরে না। চাকরি তো আর চলে যাচ্ছে না। আর যিনি শিখে ফেললেন, তিনি কয়েকদিন পর থেকেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন, কীভাবে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে যাবেন। এটাই বাংলাদেশের কমন চিত্র।

ভালো দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী হওয়াটা খুবই কঠিন একটি কাজ। এটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের লেখাপড়ায় ভালো করার চেয়েও কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক এটিচিউড এবং ট্রেনিং। এবং সর্বোপরি এমন একটা পরিবেশ, যার মাধ্যমে আমাদের কর্মীরা তাদের কর্মজীবনে প্রবেশ করে একটা সময়ে গিয়ে ভালো ম্যানেজার হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা তাদের কর্মীদের পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ করে ট্রেনিং-এর জন্য। এবং তারা ভালো ম্যানেজার পেয়েছে এবং পাচ্ছে বলে আমি জানি। কিন্তু সেই গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিলে মোটা দাগে আমাদের দেশে দক্ষ ম্যানেজার তৈরির কোনোও প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে।

পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকান। দেখুন, সবাইকে কীভাবে উদ্যোক্তা এবং সিইও বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হলো তরুণ প্রজন্মকে লোভ দেখিয়ে ভুল পথে পরিচালনা করার এক ধরনের ফন্দি। এগুলোতে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। যে মানুষগুলো জীবনে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেনি, তারাই গিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন উদ্যোক্তা বানানোর। কী ভয়ংকর কথা। আমি নিশ্চিত লিখে দিলাম, এই ছেলেমেয়েগুলো কিছু দিন এই দরজা ওই দরজায় ধাক্কা খাবে, তারপর একদিন হতাশ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে।

একটি প্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তার যেমন প্রয়োজন, তেমনি ভালো ম্যানেজারের প্রয়োজন আরও বেশি। এবং সংখ্যার পরিমাণ প্রয়োজনটাও অনেক বড়। বাংলাদেশের পরিবেশ উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য মোটেও সহায়ক নয়। এখানে ফান্ডিং জোগাড় করতেই একজনের জীবন শেষ হয়ে যাবে। এবং কেউ সেই ফান্ডিং পেলেও তার যে টার্মস থাকবে, তাতে উদ্যোক্তার আর কিছু থাকে না। ফলে এগুলো ঠিক না করে, সবাইকে উদ্যোক্তা বানাও বলে মাঠে নামিয়ে দেওয়াটা ঠিক কাজ নয়। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে গাছ এমনিতেই বেড়ে ওঠে। আপনাকে চিৎকার করতে হবে না, গাছ তুমি বড় হও।

বাংলাদেশে ভালো ম্যানেজার না হওয়ার আরও একটি দিক হলো পারিবারিক। আমরা আমাদের বাচ্চাগুলোকে পুতু-পুতু করে বড় করি। বিশেষ করে যারা একটু স্বচ্ছল পরিবারে বড় হয়, তারাই আবার ভালো স্কুল কলেজে যেতে পারে এবং সেই ছেলেমেয়েগুলোই কর্মজীবনে বেশি অংশ নিতে পারে। এবং এরাই বড় হয়েছে পুতু-পুতু আদরে।

এই ছেলেমেয়েগুলো গায়ে গতরে অনেক বড় হয়ে গেলেও এদের মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হয়নি। আমাদের ছেলেমেয়েদের শারীরিক বয়স আঠারো হলেও মনের বয়স রয়ে যায় ১০ কি ১২। যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ২৩/২৪ বছর বয়সে, তখন তাদের মানসিক বয়স হলো ১৬ কি ১৭, কিংবা আরও কম। এরা ঠিকমতো গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে পারে না, নিজের কাপড়টা আয়রন করতে পারে না। একটা কোনোও সমস্যা দেখলে আশা করে কাজের মানুষ এসে সেটা সমাধান করে দিয়ে যাবে, নিজে মানুষটা যে কিছু একটা করতে পারে, তার যে আশেপাশে আরও কাজ আছে, এটা তারা বুঝতেই পারে না।

আমাদের ছেলেমেয়েদের বড় অংশটাই পরিবারে যেভাবে বড় হয়, তারই প্রতিফলন ঘটে অফিসে এসে। তারা মনে করে, আমার কাজ ইঞ্জিনিয়ারিং, আমি কেন অন্য একটা সমস্যা সমাধান করতে যাব? তারা বুঝতে শেখে না, প্রতিটি অফিস তাকে চাকরি দিয়েছে তাদের কোনোও না কোনোও সমস্যার সমাধান করতে। একটা দায়িত্ব নিয়ে সেই সমস্যাটা যে সমাধান করবে, সেটা তার ব্রেইন ট্রিগার করে না। ফলে যে কোনোও পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের কাজটি করেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। উপর থেকে কেউ এসে তাদেরকে সাহায্য করবে যেন। আমাদের পরিবারগুলো আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে নষ্ট করেছে এবং করছে। আমরা বুঝতেই পারি না, একটি ছেলে বা মেয়েকে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের কাজটা করতে দিলে ধীরে ধীরে তার মানসিক শক্তির প্রবৃদ্ধি হবে। যে কারণে আমরা আমাদের আশেপাশের দেশের ছেলেমেয়েদের থেকে মানসিকভাবে অনেক পিছিয়ে থাকি। একজন ২৪ বছরের তরতাজা যুবকের যা করতে পারার কথা, সেটা সে পারে না। সে ওটা পারে ৩৪ বৎসর বয়সে গিয়ে। ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে যায়।

শারীরিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক বয়সও বাড়তে হবে। আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন, মনের বয়স বাড়ানোর দরকার নেই, তাহলে বুড়ো হয়ে যাব। এটা খুবই ভুল একটা ধারণা। একজন ৬০ বছরের মানুষ যদি ৩০ বছরের মানুষের মতো আচরণ করে, তাহলে তাকে দিয়ে এই জগতের কোন কাজটা হবে বলুন তো? বাংলাদেশসহ বিশ্বে যারা ভালো করেছে, দেখবেন কেউ তারা পুতুপুতু হয়ে বেড়ে ওঠেনি। তাদের শারীরিক বয়সের সঙ্গে মানসিক বয়সটাও বেড়েছে। তারা ৪০ বছর বয়সে ৪০ বছরের পরিপক্ক মানুষের মতোই তাদের ব্রেইনকে কাজে লাগিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো আরও বেশি।

মানসিক বয়স শরীরের সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে হবে। প্রতিটি বয়সের তার নিজস্ব রূপ আছে, জীবন আছে। সেই বয়সে ওই রূপটাই উপভোগ্য।