Monday, January 30, 2017

রুবাই

[১]
রাতের আঁচল দির্ণ করে আসল শুভ ঐ প্রভাত,
জাগো সাকী ! সকাল বেলার খোঁয়ারি ভাঙো আমার সাথ
ভোলো ভোলো বিষাদ-স্মৃতি ! এমনি প্রভাত আসবে ঢের,
খুজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুন নয়নপাত ।

[2]
আধার অন্তরীক্ষে বুনে যখন রূপার পাড় প্রভাত,
পাখির বিলাপ-ধ্বনি কেন শুনি তখন অকস্মাৎ?
তারা যেন দেখতে বলে উজল প্রাতের আরশিতে-
ছন্নছাড়া তোর জীবনের কাটল কেমন একটি রাত !

[৩]
“ঘুমিয়ে কেন জীবন কটাস?” কইল ঋষি স্বপ্নে মোর,
“আনন্দ-গুল প্রস্ফুটিত করতে পারে ঘুম কি তোর ?
ঘুম মৃত্যুর যমজ-ভ্রাতা তার সাথে ভাব করিসনে,
ঘুম দিতে ঢের পাবি সময় কবরে তোর জনম-ভোর ।’’

[৪]
আমার আজের রাতের খোরাক তোর টুকটুক শীরীন ঠোঁট
গজল শোনাও, শিরাজী দাও,তন্বীসাকী জেগে ওঠ !
লাজ রাঙা তোর গালের মত দে গোলাপী-রঙ শরাব,
মনে ব্যথার বিনুনি মোর খোঁপায় যেমন তোর চুনোট ।

[৫]
প্রভাত হ’ল ! শরাব দিয়ে করব সতেজ হৃদয়-পুর,
যশোখ্যাতির ঠুনকো এ কাচ করব ভেঙে চখ্ নাচুর ।
অনেক দিনের সাধ আশা এক নিমেষে করব ত্যাগ,
পরব প্রিয়ার বেণী বাঁধন, ধরব বেণুর বিধুর সুর !

[৬]
ওঠো, নাচো ! আমরা প্রচুর করব তারিফ মদ-অলস
ঔ নার্গিস্ আঁখির তোমার, ঢালবে তুমি আঙুর-রস !
এমন কী আর-জদিই তাহা পান করি দশ বিশ গেলাস,
ছয় দশে ষাট পাত্র পড়লে খানিকটা হয় দিল সরস !

[৭]
তোমার রাঙা ঠোঁটে আছে অমৃত-কুপ প্রান-সুধার,
পেয়ালার ঠোঁট যেন গো ছোঁয় না, প্রিয়া ঠোঁট তোমার
ঐ পেয়ালার রক্ত যদি পান না করি শাপ দিও,
তোমার অধর স্পর্শ করে বড় স্পর্ধা তার !

[৮]
আজকে তোমার গোলাপ-বাগে ফুটল যখন রঙীন গুল্
রেখনা পান-পাত্র বেকার, উপচে পড়ুক সুখ ফজুল ।
পান করে নে, সময় ভীষণ অবিশ্বাসী, শত্রু ঘোর,
হয়ত এমন ফুল-মাখানো দিন পাবি না আজের তুল ।

[৯]
শরাব আনো ! বক্ষে আমার খুশির তুফান দেয় দোলা ।
স্বপ্ন-চপল ভাগ্যলক্ষী জাগল জাগ ঘুম-বিভোল !
মোদের শুভদিন চলে যায় পারদ-সম ব্যস্ত পা’য়,
যৌবনের এই বহ্নি নিভে খোজে নদীর শীতল কোল ।

[১০]
আমরা পথিক ধূলির পথের, ভ্রমি শুধু একটি দিন,
লাভের আঙ্ক হিসাব করে পাই শুধু দুখ, মুখ মলিন !
খুঁজতে গিয়ে এই জীবনের রহস্যেরই কূল বৃথাই
অপূর্ণ সাদ আশা লয়ে হবই মৃত্যুর অঙ্কলীন ॥

[১১]
ধরায় প্রথম এলাম নিয়ে বিস্ময় আর কৌতুহল,
তার পর- এ জীবন দেখি কল্পনা, আঁধার অতল ।
ইচ্ছাথাক কি না থাক, শেষে যেতেই হবে, তাই বলি –
এই যে জীবন আসা-যাওয়া আঁধার ধাঁধার জট কেবল !

[১২]
রহস্য শোন সেই সে লোকের আত্মা যেথায় বিরাজে,
ওরে মানব ! নিখিল সৃষ্টি লুকিয়ে আছে তোর মাঝে ।
তুই মানুষ, তুই-ই পশু, দেবতা দানব স্বর্গদূত,
যখন হতে চাইবি রে যা হতে পারিস তুই তা যে ।

[১৩]
স্রষ্টা যদি মত নিত মোর-আসতাম না প্রানান্তেও,
এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্চা নেই মোটেও।
সংখেপে কই, চিরতরে নাশ করতাম সমূলে
যাওয়া-আসা জন্ম আমার;সেও শূন্য শূন্য এও !

[১৪]
আত্মা আমার ! খুলতে যদি পারিতাম এই অস্থিমাস,
মুক্ত পাখায় দেবতা-সম পালিয়ে যেতিস্ দুর আকাশ।
লজ্জা কি তোর হ’ল না রে , ছেড়ে তোর ঐ জ্যোতির্লোক
ভিন্-দেশী প্রায় বাস করতে এলি ধরার এই আবাস?

[১৫]
সকল গোপন তত্ত্ব জেনেও পার্থিব এই আবহাওয়ার
মিথ্যা ভয়ের ভয় গেল না ? নিত্য ভয়ের হও শিকার ?
জানি স্বাদীন ইচ্ছামত যায় না চলা এই ধরায়,
যতটুকু সময় তবু পাও হাতে, লও সুযোগ তার ।

[১৬]
ব্যথায় শান্তি লাভের তরে থাকত যদি কোথাও স্থান
শ্রান্ত পথের পথিক মোরা সেথায় জুড়াতাম এ প্রাণ।
শীত-জর্জর হাজার বছর পরে নবিন বসন্তে
ফুলের মত উঠত ফুটে মোদের জীবন মুকুল ম্লান।

[১৭]
বুলবুলি এক হালকা পাখায় উড়ে যেতে গুলিস্থান,
দেখল হাসিখুশী ভরা গোলাপ লিলির ফুল-ভাথান।
আনন্দ সে উঠল গাহি, “মিটিয়ে নে সাধ এই বেলা,
ভোগ করতে এমন দিন আর পাবিনে তুই ফিরিয়ে প্রান !”

[১৮]                                                                                 রূপ-মাধুরীর মায়ায় তোমার য’দিন পার, লো প্রিয়া ,
তোমার প্রেমিক বধুর ব্যথা হরন করো প্রেম দিয়া !          রূপ-লাবনীর সম্ভার  এই রইবে না সে চিরকাল, 
ফিরবে না আর তোমার কাছে  যায় যদি বিদায় নিয়া ।

[১৯]
সাকী ! আনো আমার হাতে মদ পেয়ালা ধরতে দাও !
প্রিয়ার মত ও মদ-মদির সুরত ওয়ালী ধরতে দাও !
জ্ঞানী এবং অজ্ঞানীরে বেঁধে যা’ দেয় গাঁট ছড়ায়,
সেই শরাবের শিকল, সাকী আমায় খালি পরতে দাও ।

[২০]
নীল আকাশের নয়ন ছেপে বাদল-অশ্রুজল ঝরে,
না পেলে আজ এই পানীয় ফুটতনা ফুল বন ভরে ।
চোখ জুড়াল আমার যেমন আজ এ ফোটা ফুলগুলি,
মোর কবরে ফুটবে যে ফুল- কে জানে হায় কার তরে !

[২১]
করব এতোই শীরাজী পান পাত্র এবং পরান ভোর
তীব্র-মিঠে খোশবো তাহার-উঠবে আমার ছাপিয়ে গোর ।
থমকে যাবে চলতে পথিক আমার গোরের পাশ দিয়ে,
ঝিমিয়ে শেষে পড়বে নেশায় মাতাল-করা গন্ধে ওর ।

[২২]
দেখতে পবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়,
জেনো, সেতায় ঝরেছিল কোনো শাহানশা’র রুধির ।
নার্গিস আরগুল-বনোসা’র দেখবে যেথায় সুনীল দল,
ঘুমিয়ে আছে সেথায় গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর ।

[২৩]
নিদ্রা যেতে হবে গোরে অনন্তকাল, মদ পিও !
থাকবে নাকো সাথী সেথায় বন্ধু প্রিয় আত্মীয় ।
আবার বলতে আসবে না ভাই বলছি যা তা রাখ্ শুনে—
ঝরছে যে ফুলের মুকুল, ফুটতে পারে আর কি ও ?

[২৪]
বিদায় নিয়ে আগে যারা গেছে চলে, হে সাকী,
চির ঘুমে ঘুমায় তারা মটির তলে, হে সাকী !
শরাব আনো, আসল সত্য আমার কাছে যাও শুনে,
তাদের যত তথ্য গেল হাওয়ায় গলে, হে সাকী !

[২৫]
তুমি আমি জন্মিনিকো—যখন শুধু বিরাম-হীন
নিশীথিনীর গলা ধরে ফিরতো হেথায় উজল দিন;-
বন্ধু, ধীরে চরণ ফেলো ! কাজল-আঁখি সুন্দরীর
আঁখির তারা আছে হেথায় হেথায় হয়ত ধূলির অঙ্কলীন !

[২৬]
প্রথম থেকেই আছে লেখা অদৃষ্টে তোর যা হবার,
তাঁর সে কলম দিয়ে- যিনি দুখে সুখে  নির্বিকার ।
স্রেফ বোকামি, কন্নাকাটি লড়তে যওয়া তার সাথে,
বিধর লখন ললাট-লিপি টলবে না যা জন্মে আর !

[২৭]
ভালো করেই জানি আমি, আছে এক রহস্য-লোক,
যায় না বলা সকলকে তা ভালোই হোক কি মন্দ হোক ।
আমার কথা ধোঁয়ায় ভরা, ভাঙতে তবু পারবো না—
থাকি সে কোন গোপন-লোকে দেখতে যাহা পায় না চোখ ।
[৩২]

খাজা ! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই-
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।

[২৮]
চলবে নাকো মেকি টাকার কারবার আর, মোল্লাজি !
মোদের আবাস সাফ করে নেয় শেয়ান-ঝাড়ুর কারসাজি
বেরিয়ে ভাঁটি-খানার থেকে বলল হেঁকে বৃদ্ধ পীর—
“অনন্ত ঘুম ঘুমাবি কাল পান করে নে মদ আজি !”

[৩৩]
কাল কি হবে কেউ জানে না দেখছ ত হায় বন্ধু মোর !
নগদ মধু লুঠ করে লও, মোছ মোছ অশ্রু লোর।
চাঁদনি-তরল শরাব পিও, হায়, সুন্দর এই সে চাঁদ
দীপ জ্বালিয়ে খুঁজবে বৃথাই কাল এ শূন্য ধরার ক্রোড়!

[৩৪]
প্রেমিকরা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,
দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পায়।
থাকি যখন শাদা চোখে, সব কথাতে রুষ্ট হই,
শরাব পিয়ে দল-দরিয়া উড়িয়ে দি ভয়-ভাবনায়।

[৩৫]
মানব-দেহ—রঙে-রূপে এই অপরূপ ঘরখানি—
স্বর্গের সে শিল্পী কেন করল সৃজন কী জানি,
এই ‘লালা-রুখ’,বল্লী-তনু ফুল্ল-কপোল তন্বীদের
সাজাতে হায় ভঙ্গুর এই মাটির ধরার ফুলদানি !

[৩৭]
দোষ দেয় আর ভৎসে সবাই আমার পাপের নাম নিয়া,
আমার দেবী-প্রতিমারে পূজি তবু প্রাণ দিয়া।
মরতে যদি হয় গো আমার শরাব-পানের মজলিশে—
স্বর্গ-নরক সমান, পাশে থাকবে শরাব আর প্রিয়া।

[৩৮]
মুসাফিরের এক রাত্রির পান্থ-বাস এ পৃথ্বীতল—
রাত্রি-দিবার চিত্র-লেখা চন্দাতপ আঁধার-উজল।
বসল হাজার জামশেদ ঐ উৎসবেরই আঙ্গিনায়
লাখ বাহ্ রাম এই আসনে বসে হ’ল বেদখল।

[৩৯]
কারুর প্রাণে দুখ দিও না, করো বরং হাজার পাপ,
পরের মনের শান্তি নশি বাড়িও না তার মনস্তাপ।
অমর-আশিস্ লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,
আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।

[৪০]
ছেড়ে দে তুই নিরস বাজে দর্শন শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণীর ঠাট্
ঐ সোরাহির হৃদয়-রুধির নষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধর পিয়ে কখন মৃত্তু হয় লোপাট।

[৪১]
অজ্ঞানেরই তিমির-তলের মানুষ ওরে বে-খবর !
শূন্য তোরা, বুনিয়াদ তোর গাঁথা শূন্য হওয়ার পর।
ঘুরিস অতল অগাধ খাদে, শূন্য মায়ার  শূন্যতায়,
পশ্চাতে তোর অতল শূন্য অগ্রে শূন্য অসীম চর।

[৪২]
লয়ে শরাব-পাত্র হাতে পিই যবে তা মত্ত হয়ে
জ্ঞান-হারা হই সেই পুলকের তীব্র-ঘোর বেদন সয়ে,
কি যেন এক মন্ত্র-বলে যায় ঘটে কি অলৌকিক,
প্রোজ্জ্বল মোর জ্ঞান গলে,যায় ঝর্ণা-সম গান বয়ে।

[৪৩]
“শরাব ভীষণ খরাপ জিনিস মদ্যপায়ীর নেইকো ত্রাণ। ”
ডানে বাঁয়ে দোষদর্শীয় সমালোচক ভয় দেখান—
সত্য কথাই ! যে আঙুরে নষ্ট করে ধর্মমত,
সবার উচিত—নিঙড়ে ওরে করে উহার রক্ত পান !

[৪৪]
আমার কাছে শোন উপদেশ—কাউকে কভু বলিসনে—
মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চিলসনে !
দু:খ ব্যথায় টলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,
চাসনে ব্যথার সমব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে !

[৪৫]
মউজ চলুক ! লেখার যা তা লিখল ভাগ্য কালকে তোর,
ভুলও কেহ পুঁছল না কি থাকতে পরে তোর ওজর !
ভদ্রতারও অনুমতি কেউ নিল না অমনি ব্যস্
ঠিকঠাক সব হয়ে গেল ভুগবি কেমন জীবন-ভোর !

[৪৬]
সেই সাথে চাই—সৃষ্টি খাতায় দিক কেটে সে আমার নাম,
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্টতর
আকাশ ভুবন এই এখনই, এই সে আমার আঁখির’পর ।
কিংবা আমার যা প্রয়োজন তা মিটাবার দিক সে বর ।

[৪৭]
নাস্তিক আর কাফের বলো তোমারা লয়ে আমার নাম
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম ।
অস্বীকার তার করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিৎ এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম ?

[৪৯]
মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়
রাত্রি-দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ-সুখের লোভ দেখায় ।
ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের
ভোলে না এই খোশ-গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায় ।

[৫০]
এক হাতে মোর তসবী খোদার, আর-হাতে মোর লাল গেলাস
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস ।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁট মুসলিমও—
করুন চোথে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ ।

[৫১]
একমণী ঐ মদের জালা গিলব, যদি পাই তাকে,
যে জালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে !
পুরানো ঐ যুক্তি তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,
নতুন করে করব নকাহ্ আঙুর-লতার কন্যাকে ।

[৫২]
বিষাদের ঐ সওদা নিয়ে বেড়িয়ো না ভাই শিরোপরি,
আঙুর-কন্যা সুরার প্রেম ক’রে যাও প্রেম ক’রে যাও প্রাণ ভরি !
নিষিদ্ধা ঐ কন্যা, তবু হোক সে যতই অ-সতী,
তাহার সতী মায়ের চেয়ে ঢের বেশী সে সুন্দরী !

[৫৩]
স্বর্গে পাব শরাব-সুধা এ যে কড়ার খোদ খোদার,
ধরায় তাহা পান করলে পাপ হয়, এ কোন বিচার?
‘হামজা’ সাথে বেয়াদবি করল মাতাল এক আরব,-
তুচ্ছ কারণ—শরাব হারাম তাই হুকুমে ‘মোস্তফার’!

[৫৪]
“রজব শাবান পবিত্র মাস” বলে গোঁড়া মসলমান,
“সাবধান, এই দু’মাস ভাই কেউ ক’রো না শরাব পান ।”
খোদা এবং তার রসুলের ‘রজব’ ‘শাবান’ এই দু’মাস
পান-পিয়াসীর তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ রমজান ?

[৫৫]
শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার,
হাত যেন ভাই খালি না যায়, শরাব চলুক আজ দেদার ।
এক পেয়লি শরাব যদি পান করো ভাই অন্যদিন,
দু’পেয়ালি পান করো আজ বারের বাদশ জম্মা বার ।

[৫৭]
মুগ্ধ করো নিখিল হৃদয় প্রেম-নিবেদন কৌশলে
হৃদয়-জয়ী হে বীর, উড়া্ও নিশান প্রিয়ার অঞ্চলে ।
এক হৃদয়ের সমান নহে, লক্ষ মসজিদ আর কাবা
কি হবে তোর তীর্থে ‘কাবা’র শান্তি খোঁজ হৃদয় তলে ।

[৬০]
মদ পিও আর ফুর্তি করো—আমার সত্য আইন এই !
পাপ পূন্নের খোজ রাখি না—স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই ।
ভাগ্য সাথে বিয়ের দিনে কইনু, “দিব কি যৌতুক?”
কইল বধূ, “খুশি থাকো, তার বড় যৌতুক সে নেই !”

[৬১]
কে সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর
প্রিয়া সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার,
জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ,
এই যদি পাই চাইব নাকো তখৎ আমি শাহানশার !

[৬২]
হুরী বলে থাকলে কিছু—একটি হুরী, মদ খানকি
ঘাস-বিছানো ঝর্ণাতীরে, অল্প বয়েস, বৈতালিক—
এই যদি পাস, স্বর্গ নামক পুরনো সেই নরকটায়,
চাসনে যেতে, স্বর্গ ইহাই, স্বর্গ যদি থাকেই ঠিক ।

[৬৩]
যতক্ষণ এ হাতের কাছে আছে অঢেল লাল শরাব
গেঁহুর রুটি, গরম কোর্মা কালিয়া আর শিক-কাবাব,
আর লালা-রুখ প্রিয়া আমার কটীর-শয়ন-সঙ্গিনী,-
কোথায় লাগে শাহান-শাহের দৌলৎ ঐ বে-হিসাব !

[৬৪]
দোষ দিও না মদ্যপায়ীর তোমরা, যারা খাওনা মদ,
ভালো করার থাকলে কিছু, মদ খাওয়া মোর হ’ত রদ্ ।
মদ না পিয়েও, হে নীতিবিদ্, তোমরা যে-সব কর পাপ,
তাহার কাছে আমরা শিশু, হইনা যতই মাতাল-বদ !

[৬৫]
খুশী-মাখা পেয়ালাতে ঐ গোলাপ-রক্ত মদ-মধুর !
মধুরতর পাখীর গীতি, বেণুর ধ্বনি বীণার সুর ।
কিন্তু ঐ যে ধর্মগোঁড়া-বুঝল না যে মদের স্বাদ,
মধুরতম—রয় সে যখন অন্ততঃ পাঁচ যোজন দূর ।

[৬৬]
চৈতী-রাত্রে খুঁজে নিলাম তৃণাস্তৃত ঝর্ণা তীর,
সুন্দরী এক হুরী নিলাম, পেয়ালা নিলাম লাল পানির ।
আ,ার সা, েকইল গাহার তুৎসা গ্লানির ঝড় তুফান,
ভুলেও মনে হ’ল না মোর স্বর্গ নরকের নজীর ।

[৬৭]
সাকী-হীন ও শরাব-হীনের জীবনে হায় সুখ কী বল ?
নাই ইরাকী-বেণুর ধ্বনির জমজমাটি সুর-উছল
সুখ নাই ভাই সেথায় থেকে, এই জগতের তত্ত্ব শোন,
আনন্দ-হীন জীবন-বাগে ফলে শুধু তিক্ত ফল ।

[৬৮]
মরুর বুকে বসাও মেলা, উপনিবেশ আনন্দের,
একটি হৃদয় খুশী করা তাহার চেয়ে মহৎ ঢের ।
প্রেমের শিকল পরিয়ে যদি বাঁধতে পার একটি প্রাণ—
হাজার বন্দী মুক্ত করার চেয়েও অধিক পুণ্য এর ।

[৬৯]
শরাব এবং প্রিয়ায় নিয়ে, সাকী, হেথায় এলাম ফের ।
তৌবা করেও পাইনে রেহাই হাত হতে ভাই এই পাপের ।
”নূহ’ আর তাঁর প্লাবন-কথা শুনিয়ো নাকো আর, সাকী,
তার চেয়ে মদ-প্লাবন এনে ডুবাও ব্যথা মোর বুকের !

[৭৩]
মধুর, গোলাপ-বালার গালে দক্ষিন হাওয়র মদির শ্বাস,
মধুর, তোমার রুপের কুহক মাতায় যা এই পুস্পাবাস ।
যে গেছে কাল গেছে চলে এলো না তার ‘ম্লান স্মৃতি’
মধুর আজের কথা বল, ভোগ করে নাও এই বিলাস ।

[৭৪]
শীত ঋতু ঐ হল গত বইছে বায় বসন্তের,
জীবন পুথির পাতাগুলি পড়বে ঝ’রে, নাই দেরি ।
ঠিক বলেছেন দরবেশ এক’ “দুষিত বিষ এই জীবন,
দ্রক্ষার রস বিনা ইহার প্রতিষেধক নাই, হেরি ।”

[৭৫]
সরো‘র মতন সরল-তনু টাটকা-তোলা গোলাপ-তুল,
কুমারীদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দে তুই হ’মশগুল !
মৃত্যুর ঝড় উঠবে কখন আয়ুর পিরাণ ছিড়বে তোর—
পড়ে আছে ধুলায় যেমন ঐ বিদীর্ণ্ দল মুকুল !

[৭৭]
আমার সাথী সাকী জানে মানুষ আমি কোন জাতের,
চাবি আছে তার আঁচলে আমার বুকের সুখ দুখের ।
যেমনি মেজাজ মিইয়ে আসে গেলাস ভরে দেয় সে মদ,
এক লহমায় বদলে গিয়ে দূত হয়ে যাই দেব লোকের ।

(১২১)
নিত্য দিনে শপথ করি—করব তৌবা আজ রাতে,
যাব না আর পানশালাদে, ছোঁব না আর মদ হাতে ।
অমনি আঁখির আগে দাঁড়ায় গোলাপ ব্যাকুল বসন্ত
সকল শপথ ভুল হয়ে যায়, কুলোয় না আর তৌবাতে ।