কোনো না কোনো সময় যে কেউ জোড়ার আঘাতে ভুগতে পারে। তবে পেশাদার বা শৌখিন খেলোয়াড়দের মাঝে এ সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। মানব শরীরে ২০৬টি হাড় থাকে এবং এদের সমন্বয়ে ছোটবড় প্রায় ১৪৭টি জোড়া তৈরি হয়। খেলাধুলা, বিভিন্ন ধরনের একসিডেন্ট, শারীরিক আঘাত ও পেশাগত কাজ থেকে জোড়া আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। ইনজুরি বা আঘাতের সময়কাল বিবেচনা করলে, কিছু আঘাত তৎক্ষণাৎ এবং কিছু আঘাত দীর্ঘসময় ধরে (ওভার ইউজ ইনজুরি) হয়। ইনজুরি বা আঘাত জোড়াকে বিভিন্ন স্তরে আক্রান্ত করে। আঘাতের তীব্রতা অনুসারে জোড়ার আবরণ, লিগামেন্ট, হাড়, তরুনাস্থি বা মেনিসকাস এবং পেশি আক্রান্ত হয়। শরীরের যে কোনো জোড়া আক্রান্ত হতে পারে। তবে গোড়ালি, হাঁটু, কটি, কাঁধ, কনুই, মেরুদ- ও আঙুলের জয়েন্ট আঘাতে বেশি ভোগে।
আঘাতের কারণসমূহ
১. হঠাৎ মোচড়ানো (টুইসটিং) মুভমেন্ট।
২. জোড়ায় সরাসরি আঘাত।
৩. রিকশা থেকে পড়ে গেলে, গাড়ি বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় জয়েন্ট ইনজুরি হয়।
৪. ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল, কাবাডি ও হা-ডু-ডু খেলোয়াড়দের জোড়া ইনজুরির প্রবণতা বেশি।
৫. মই থেকে পড়লে, ওপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লে এবং গর্তে পড়ে গেলে জোড়া ইনজুরি হয়।
৬. সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক স্টেপ ভুল করলে।
৭. বয়স্কদের ব্যবহারজনিত ক্ষয়ের জন্য জোড়া ইনজুরি হয়।
৮. পেশাগত কারণে দীর্ঘসময় দাঁড়ালে, বসলে, জোড়া নড়াচড়া করলে এবং হাত উঁচু করে কাজ করলে জয়েন্ট ইনজুরি হয়।
৯. সামনে ঝুঁকে ভারী ওজন তুললে।
আঘাতের প্রকারভেদ
১. জোড়ার চারপার্শ্বের চামড়া টিয়ার ও চামড়ায় রক্তক্ষরণ।
২. পেশির স্ট্রেইন, রক্তক্ষরণ ও টিয়ার বা ছিঁড়ে যাওয়া।
৩. লিগামেন্ট স্প্রেইন ও আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যাওয়া।
৪. জোড়ার আবরণ বা ল্যাবরাম ছিঁড়ে যাওয়া।
৫. আংশিক বা সম্পূর্ণ হাড় ভাঙা।
৬. জয়েন্ট আংশিক বা সম্পূর্ণ স্থানচ্যুতি হতে পারে।
৭. তরুনাস্থি বা মেনিসকাস আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিঁড়তে পারে।
আঘাতের উপসর্গ
১. প্রথমে তীব্র ব্যথা, পরে আস্তে আস্তে ব্যথা কমে আসে।
২. জোড়া নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়।
৩. আঘাতের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে বা ২/৩ ঘণ্টা পর জোড়া ফুলে যায়।
৪. ফুলা ও ব্যথার জন্য মুভমেন্ট করা যায় না।
৫. দাঁড়াতে বা হাঁটতে চেষ্টা করলে মনে হবে জোড়া ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে।
৬. আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ‘পপ’ বা ‘ক্র্যাক’ শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারে।
৭. কিছুদিন পর বেশিক্ষণ বসলে, হাঁটু বা পা সোজা করতে কষ্ট হয় বা আটকিয়ে যায়।
৮. অনেক সময় আঘাতের অনেক দিন পর জোড়া ফুলে যায়, ভালো হয় এবং আবার ফুলে। এভাবে চলতে থাকে।
৯. দীর্ঘদিন যাবৎ ইনজুরি থাকলে পেশি শুকিয়ে যায় এবং জোড়ায় শক্তি কমে যায়।
১০. উঁচু-নিচু জায়গায় হাঁটা যায় না, সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয়।
১১. কাঁধ ও কনুই ইনজুরির জন্য কাত হয়ে ঘুমানো, পিঠ চুলকানো, জামার বোতাম লাগানো, চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ানো এবং হাত দিয়ে ওজন তোলা যায় না।
১২. জোড়ার অস্বাভাবিক আকৃতি বা অবস্থান।
১৩. খেলোয়াড় কখনো ইনজুরির পরপরই মাঠ ত্যাগ করে অর্থাৎ খেলা সম্ভব হয় না। কখনো কখনো অবশ্য খেলা চালিয়ে যাওয়া যায় এবং শেষের দিকে মাঠ ত্যাগ করতে হয়।
জরুরি চিকিৎসা
১. জোড়াকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
২. বরফের টুকরা টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি প্লাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে আসবে। প্রতি ঘণ্টায় ১০ মিনিট বা দুই ঘণ্টা পরপর ২০ মিনিট অনবরত লাগাতে হবে। তবে এটা সহ্যের মধ্যে রাখতে হবে। এই পদ্ধতি আঘাতের ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলবে।
৩. জোড়ায় ইলাসটো কমপ্রেসন বা স্পিলিন্ট ব্যবহারে ফুলা ও ব্যথা কমে আসে।
৪. জোড়ার নিচে বালিশ দিয়ে উঁচু করে রাখলে ফোলা কম হবে।
৫. কোমরে সাপোর্ট বা কোরসেট ব্যবহার করতে হবে।
৫. এনালজেসিক বা ব্যথানাশাক ও দরকার হলে এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন।
৬. হাড় ভাঙলে বা জোড়া স্থানচ্যুতি হলে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তার করতে হবে।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা
প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা ও ফোলা সেরে ওঠার পর, জোড়ার বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে কি কি লিগামেন্ট, পেশি বা মেনিসকাস ইনজুরি হয়েছে এবং এর তীব্রতা নির্ণয় করতে হবে। কখনো কখনো এক্সরে ও এমআরআই-এর সাহায্য নিতে হয়। লিগামেন্ট, মেনিসকাস, জোড়ার আবরণ ও পেশি ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম এমন আর্থ্রােস্কোপিক চিকিৎসকের কাছে বা সেন্টারে রোগীকে পাঠাতে হবে। প্রাথমিক বা শল্য চিকিৎসার পর নিয়মিত ও উপযুক্ত পরিচর্যা করে জোড়ার স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরিয়ে আনা সম্ভব।